স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
গুজরা শ্যামাচরণ
উচ্চ বিদ্যালয় – স্থাপিত ১৯৬৯ ইং
রাউজান, চট্টগ্রাম
গুজরা শ্যামাচরণ উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে বলতে বা লিখতে গেলে প্রথমেই
শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করতে হয় দানবীর স্বগীর্য় শ্যামাচরণ মহাজনের নাম। দেশে ও বিদেশে
(মায়ানমার) ব্যবসায়ের সুবাদে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তি ও অর্থবিত্তের অধিকারী
হয়েছিলেন। তাই সমাজে ও এতদঞ্চলে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। গুজরা শব্দের
আভিধানিক অর্থ ব্যাপক এলাকা। তৎকালীন বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে যখন গুজরা এলাকায়
শিক্ষার আলো প্রায় নিষ্প্রভ ছিল, ঠিক সেই সময় এই অঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বালাতে তিনি
এগিয়ে আসেন। ১৯৩৭ ইং সনে তাঁরই স্বীয় প্রচেষ্টায় এবং নিজের দানকৃত ভূমিতে
প্রতিষ্ঠিত গুজরা শ্যামাচরণ প্রাথমিক বিদ্যালয় এই অঞ্চলে শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র
রূপে গড়ে ওঠে। বাবু শ্যামাচরণ মহাজন, উনার জীবদশায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্টা করার একান্ত
ইচ্ছা পোষন করেছিলেন। তাঁর এই ঐকান্তিক ইচ্ছা পূরণের কথা তিনি মৃত্যুশয্যায় তার আপনজনদের
এবং স্থানীয় গণপ্রতিনিধিদের মধ্যে প্রকাশ করেছিলেন। প্রাক্তন চেয়ারম্যান মরহুম আলহাজ্ব নূরুল
হক মাষ্টার ও মরহুম আলহাজ্ব ওসমান আলী মাষ্টার মহাজন বাবুর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের
জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। মহাজন বাবুর একমাত্র সন্তান মাস্টার শীতাংশু
বিমল মহাজন এর সভাপতিত্বে উনার বাড়িতে
অনুষ্ঠিত এক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে মহাজন বাড়ীস্থ ও স্থানীয় শিক্ষানুরাগী
ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ১৯৬৯ সনের শীতকালীন সময়ে রাত্রের প্রথম প্রহরে ছাত্র সংগ্রহ
অভিযানে বের হয়ে অভিভাবকদের সাথে উচ্চবিদ্যালয় করার সহযোগিতার আশ্বাস চেয়েছিলেন সবাই
দলবদ্ধ হয়ে। কিছুদিন যাবৎ এইরূপ ছাত্র সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত থাকে। এই অভিযানে অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছিলেন জনাব নুরুল হক
মাষ্টার, জনাব এবাদুর রহমান, জনাব আবদুল হক, জনাব বাচা মিয়া, জনাব শামসুল হুদা,
বাবু মতিলাল দাশ, বাবু শীতাংশু বিমল
মহাজন, বাবু প্রভাত কুমার দাশ, বাবু দীনবন্ধু দে, এবং
প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এতে স্থানীয় জনগনের
প্রস্তাবিত হাইস্কুলে ছাত্র প্রেরণের বেশ সাহায্য সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া যায়।
বিশেষ করে আলহাজ্ব নূরুল হক মাষ্টার
সাহেবের নির্দেশনায় ও পরামর্শে শিক্ষিত তরুনেরা উৎসাহী হয়ে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি
থেকে উচ্চবিদ্যালয়ের কার্যক্রম আরম্ভ করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ছাত্র ভর্তি সহ পাঠদান
শুরু করেন। বাবু মতিলাল দাশ গুপ্তকে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি হলেন
প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। পরে নিয়োগ
দেওয়া হয় প্রধান শিক্ষক হিসেবে বাবু বিপিন বড়ুয়াকে। উনি কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতেই তিনি বিদ্যালয়
পরিত্যাগ করেন। কয়েকজন স্থানীয় শিক্ষিত তরুন বিনাবেতনে
শিক্ষকতায় যোগদান করে বিদ্যালয়ের পাঠদান কাজ চলমান রাখেন। মহাজন
বাড়ির বাবু স্বপন কান্তি দাশ, বাবু তপন কান্তি
দাশ, বাবু প্রভাত কান্তি দাশ, প্রতিবেশী জনাব ফজলুল কাদের, জনাব শেখ আহমদ, জনাব
শামসুল হুদা প্রমুখ অনেকেই শিক্ষকতায়
অংশগ্রহন করেছিলেন। বিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন, সমতল, মাটি
ভরাট ইত্যাদি কার্যে ও জোৎস্নালোকিত রাত্রে উৎসাহী তরুনেরা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতেন।
মহাজনের প্রতিষ্ঠিত পুরোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় যে কোনো সময় ভঙ্গুর অবস্থায় ধংস
প্রাপ্ত হয়ে যেতে পারে এবং জীবন হানির আশংকা আছে মর্মে রিপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে
একটি পাকা ভবন সরকারী শিক্ষাকর্মকর্তা কর্তৃক মঞ্জুর করা হয়। বয়োবৃদ্ধ নূরুল হক
সাহেবের পরামর্শে একাজে বিশেষভাবে সহায়তা করেন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবু
দীনবন্ধু দে এবং এলাকার তরূণ রাজনীতিবিদ এবং বিদ্যেৎসাহী জনাব আবদুস ছালাম।তিনি ১০০ টাকায় সরকার হতে ভবনটি লিজ নেন এবং এই টাকা তিনি ব্যক্তিগত ভাবে বিদ্যালয়ের পক্ষে পরিশোধ করেন। রাউজান
থানা প্রাথমিক শিক্ষাকর্মকর্তা আবদুল
মুনাফ সাহেব জনাব আবদুস ছালাম সাহেবের বিশেষ পরিচিত বন্ধু হওয়ায় নতুন বিদ্যালয় ভবন মঞ্জুরীর কাজ ত্বরান্বিত হয়। সরকার প্রদত্ত বিদ্যালয় ভবনের কাজ সম্পন্ন হলে পুরোনো
প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল হাই স্কুল হিসেবে সরকারি
অনুমোদন লাভ করা। সালাম সাহেব এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন বিদ্যালয়
হিতাকাঙ্খীদের পক্ষে। বস্তুত: নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সহায়তায় DDPI ও DEO অফিসে যোগাযোগের মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিদর্শন করত: এবং স্বীকৃতি লাভের শর্তসমূহ পূরণ করা যেমন জমি জমা বিদ্যালয়ের নামে রেজিষ্ট্রেশন, ক্যাটাগরি ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্র সংখ্যা, তহবিল গঠন, কমিটি ইত্যাদি কার্য সম্পাদনে সালাম সাহেব ুঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সময়ে সময়ে তিনি নিজ তহবিল থেকে বিদ্যালয়ের জন্য
অর্থ ব্যয় করতেন
এবং শিক্ষকদের প্রণোদনামূলক বোনাস দিতেন। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। জীবন মরন সমস্যার মধ্যে বিদ্যালয়
কার্যক্রম অচল ছিল। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস পর যুদ্ধাবসানে দেশ
স্বাধীন হলে পুনরায় দেশের জনজীবনে কর্মতৎপরতা শুরু হয়। পরবর্তীতে সেচ্ছাসেবক
শিক্ষকের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হওয়ায় ১০-০৪-১৯৭২ ইং
তারিখে খগেন্দ্রলাল বড়ুয়াকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে গুজরা শ্যামাচরণ উচ্চ বিদ্যালয়ে
নিয়োগ দেওয়া হয়। বিদ্যালয়টি জুনিয়র স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে ০১-০১-১৯৭৩ ইং
থেকে। এক্ষণে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলেই জুনিয়র থেকে উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে বিদ্যালয়কে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেন।
উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম দাতা জনাব আলহাজ্ব ইদ্রিচ মিঞা, দানবীর মৃদুল কান্তি দে,
জনাব নূরুল আমীন, বাবু প্রফুল্ল রঞ্জন বড়ুয়া প্রমুখ অনেক বিশিষ্ট জন বিদ্যালয়ের
উন্নয়ন কাজে জড়িত হন। মৃদূল বাবু কর্তৃক
প্রধান শিক্ষকের বাসভবন, জনাব আবদুস সালাম কর্তৃক সালাম ভবন, বিজ্ঞানাগারের
আসবাবপত্র, মৃদুল বাবু কর্তৃক মৃদুল ভবন নির্মান, লাইব্রেরীতে বই দান,
বিজ্ঞানাগারে সরঞ্জাম দান, শিক্ষা সেমিনার একাডেমিক ভবন, বিজ্ঞান ভবন সহ উন্নয়নমূলক
অনেক কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়েছিল। বিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি,
পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যাবলী ইত্যাদি ক্ষেত্রে
বিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুন্ন রয়েছে। দুই বিদ্যালয়ের অবস্থান স্থান বিনিময় বা অদল
বদলের কারণে দৃষ্টিনন্দন হয়েছে বিদ্যালয়ের স্থাপনা। বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ও
শৃঙ্খলা বজায় আছে। গুজরা শ্যামাচরণ উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে ৯ম শ্রেণি খোলার অনুমতি
লাভ করে ০১-০১-১৯৭৬ ইং থেকে ।স্বর্গীয় শ্যামাচরণ মহাজনের একমাত্র পুত্র শিক্ষক
বাবু শীতাংশু বিমল মহাজন এবং অংশীজনের মধ্যে বাবু বাদল কান্তি দাশ, বাবু তপন
কান্তি দাশ ও বাবু মৃদুল কান্তি দাশ উভয় বিদ্যালয়ের জন্য ১৬৫ শতক ভূমি দান করেন। জনাব মোহাম্মদ মিঞা সওদাগর ৩ শতক জমি
বিদ্যালয়কে দান করেন। সরকারী পরিদর্শনের
রিপোর্টের শর্তমতে বি.এড শিক্ষক প্রধান শিক্ষক হিসেবে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম
নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব আবদুল মোতালেব চৌধুরী। নানা কারণে শিক্ষক
শিক্ষিকা বিদ্যালয় পরিত্যাগ কিংবা অবসর গ্রহণ করলে ও পরবর্তীতে শিক্ষক নিয়োগ করত:
শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। শিক্ষকদের আন্তরিক শিক্ষাদানের ফলশ্রুতিতে অনেক
কৃতি ছাত্রছাত্রী ক্ষেত্রবিশেষে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আছে। তাঁরা কর্মক্ষেত্রে
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, উকিল, ম্যাজিষ্ট্রেট, শিক্ষাকর্মকর্তা, ব্যবসায়ী,
চাকুরিজীবী, গণপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণি পেশায়
নিয়োজিত এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে জড়িত।
পরিশেষে
বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মঙ্গল কামনা করি।
প্রধান শিক্ষক
